গল্পঃ দায়বদ্ধতা
গল্পঃ দায়বদ্ধতা
লেখাঃ সাদিয়া রহমান দৃষ্টি
লেখাঃ সাদিয়া রহমান দৃষ্টি
আজকের মতো ক্লাস শেষ। কিছু নোট কপি করার পরই বাড়ি ফিরবো। অন্যদিন ভার্সিটি শেষে একটা টিউশানি করাই। কিন্তু আজ ছুটি নিয়েছি। মা অসুস্থ, আজ একটু আগেই যেতে হবে। ভার্সিটি থেকে আমার বাড়ি যেতে আধঘন্টা বা চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু টিউশানি করালে বাড়ির উল্টো পথে যেতে হয়। তখন প্রায় ১ ঘন্টার রাস্তা হয়ে যায়। বেশীরভাগ দিন হেঁটেই বাড়ি ফিরি। বাড়িতে আমি, মা আর আমার ছোট বোন। বাবার সাথে মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে প্রায় ৭ বছর। এরপর থেকে মা অনেক কষ্ট করে আমাদেরকে আগলে রেখেছেন৷ ইদানিং মায়েরও বয়স হয়ে যাচ্ছে, শরীরটা প্রায়ই খারাপ থাকে। তাই সংসারের কিছু দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়েছে। কারণ আমি তো বাড়ির বড় মেয়ে। আমার বোন টা তো ছোট।
আমি মোট তিনটা টিউশানি করাই। প্রতিদিন ভার্সিটি শেষে একটা টিউশানি থাকে।আগে মা খুব কষ্ট করে রান্না বান্না করে মানুষজনদের সাপ্লাই দিতো। ইদানিং মা অসুস্থ থাকায় আমরা মাকে ওই ভাবে অন্যের জন্য রান্না বান্না না করতে বাধ্য করেছি। এই জন্যেই আমার টিউশানি নেওয়া।। আর আমাদের খুব সামান্য কিছু জমি আছে আর থাকার মতো দুতলা বাড়িটা। যেটার উপর তলা ভাড়া দেওয়া আছে। আর নিচ তলায় আমরা থাকি। মোটামুটি এইভাবে একটু টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে আমাদের সংসার খরচ, আমাদের দুই বোনের পড়াশোনার খরচ, মায়ের চিকিৎসার খরচ সব হয়ে যায়।
নোট গুলো কপি করা হয়ে গিয়েছে অবশেষে। আজ কপি করতে এসে অনেক হয়রানি হতে হল। লম্বা লাইন। তাই অনেক সময় লেগে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১২.৩৫ বাজে। খুব ক্ষুধা পেয়েছে।আজ আসার সময় কিছুই খেয়ে আসা হয়নি। মা অসুস্থ, তাই আমাকেই রান্না করতে হয়েছে। রান্না করে মাকে খাবার দিতে দিতে আমার দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজে খাওয়ার সময় পাইনি। পেটের ভেতর সুচো গুলা যেন নড়াচড়া করছে। যাই হোক, ভাবলাম এখন তো বাড়িতেই যাবো, তারপর একবারে খেয়ে নেওয়া যাবে। তবে বাড়ি যাওয়ার আগে মায়ের জন্য ওষুধ নিতে হবে। সাথে কিছু ফলমূল। তাই সোজা ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনে নিলাম। ওষুধের দোকান থেকে ২ মিনিট হাঁটলেই সারি সারি ফলের দোকান। ফলের দোকানে যেতে যেতে ভাবলাম ফল কেনা হলে রিক্সা নিয়ে নেব। আজ রিক্সা করেই বাড়ি ফিরবো। আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। হেঁটে যেতে পারবোনা।
ফলের দোকানের কাছে যেতেই দেখলাম, ১১-১২ বছরের একটা ছোট ছেলেকে এক দোকানদার মারছে। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই দোকানী বললেন ছেলেটি নাকি ২ টা আপেল চুরি করে দৌড় দিতে লেগেছিল। কিন্তু একজন তাকে ধরে ফেলেছে। অনেক রিকুয়েস্ট করার পর তারা ছেলেটিকে ছেড়ে দিলেন। আমি ছেলেটিকে বললাম তোমার নাম কি??
-
রফিক।
-
রফিক।
-তুমি থাকো কোথায়?
- সামনের ঐ গলি দিয়া গেলে যেই বস্তি আসে ওইহানে।
- আচ্ছা তুমি ফল কেন চুরি করছিলে?
-আমার মায়ের অসুখ করসে। আমার মায়ের কেচ্চু খাওন নাই। আমার মায়ে বিছনাত পইড়া রইছে।
- তোমার বাসায় আর কেউ নেই?
- না।
খুব খারাপ লাগলো ছেলেটির জন্য। তারপর তাকে নিয়ে ফলের দোকানে গেলাম, এক কেজি আপেল, এক হালি কমলা আর দুটা ছোট সাইজের আনারস কিনলাম। সেখান থেকে ২ টা আপেল, ১ টা কমলা আর একটা আনারস একটা পলি ব্যাগ এ করে ছেলেটির হাতে দিলাম। আর বাকি গুলো আমার ব্যাগে রেখে দিলাম আমার মায়ের জন্য। ছেলেটিকে পাশে নিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বললাম, বাবু তুমি খুব ছোট। কিন্তু তোমায় আজ কয়েকটা কথা বলবো, যেটা তোমার কাজে লাগতে পারে। তোমার নাম তো রফিক তাইনা?
- হ, রফিকই তো। ক্যা, নাম দিয়া কি অইবো?
- হবে অনেক কিছুই হবে। তোমার নামের সাথে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।শোন, রফিক নামের একজন ব্যক্তি তার কাজের জন্য আমাদের কাছে স্মরনীয় হয়ে আছেন। রফিক একজন ভাষা শহিদের নাম। আমরা যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি, এই ভাষার জন্য তিনি লড়াই করেছেন। এমনকি নিজের জীবন দিতেও দ্বিধা বোধ করেননি। তোমাকে এই কথা গুলো এই জন্যই বললাম, কারণ তোমার নামের মধ্যেই লড়াই শব্দটা লুকিয়ে আছে। আর জীবনে টিকে থাকতে হলে লড়াই করতেই হবে। তাই আজ থেকে যত কষ্টই আসুক তুমি আর চুরি, ছিনতাই এসব করবেনা। দরকার হলে কুলিগিরী করবে কিন্তু চুরি ছিনতাই করবেনা। যত কষ্টই হোক, কাজ করবে। কোন কাজকে ছোট করবেনা।
- ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়েই ছিল। সে বলল, আজক্যা থাইক্যা আমি আমার মারে কাম কইরা খাওয়ামু।
- এইতো, ভালো ছেলের মতো কথা। কিছু খেয়েছো সারাদিন? তোমার মা খেয়েছে??
- আম্মায়ে দুইডা ডাইলভাত খাইবার চাইছিল।
- আমি ব্যাগ খুলে দেখলাম ব্যাগে ৪৯০ টাকা আছে। ছেলেটির হাতে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম কিছু খাবার কিনে নিয়ে মায়ের সাথে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিও।
- ছেলেটি বলল আফা আপনে বড় ভালা।
- তাই? আচ্ছা তাহলে কি কথা থাকলো কাল থেকে কাজ করে মাকে দেখাশোনা করবা কেমন?
- হ আফা।
ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। শরীরে ক্লান্তি থাকলেও ব্যাগে টাকা নেই।। তাই রিক্সা আর নেওয়া হলনা। আর মাত্র ৩৯০ টাকা আছে। কখন কি লাগে না লাগে কিছু টাকা তো হাতে রাখতে হয়। টিউশানির টাকা পেতে আরও ২ দিন বাকি।। তাছাড়া আর তো একটু রাস্তাই বাকি। আর একটু হাঁটলেই বাড়ি। কতদিন কষ্ট করেছি, আর একদিন না হয় করলাম। সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা তো থাকেই। সেটার জন্য না হয় আজ একটু কষ্ট করলাম। এই কষ্টের মাঝেও কিন্তু সুখ আছে।। আর সবচেয়ে বড় কথা বাড়ি গিয়ে মা আর বোনের মুখ টা দেখলে ক্লান্তি গুলো এমনিই শক্তিতে পরিণত হবে।
No comments